আবার কিছু মানুষ দেখবেন, তারা ইসলামে প্রবেশ করে এক বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতার ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। কেউ হয়তো গাড়ি দুর্ঘটনার পর ইসলামে ফিরে আসে। কেউ-বা সার্জারি করার পর। কেউ আসে সন্তান হারানোর বেদনার পর। কেউ-বা প্রতারণার শিকার হয়ে। কেউ আবার তীব্র ঝড়ো আঘাতের পর।
অনেকেই এমন আছে যারা রোগের কারণে মর মর হয়ে ইসলামে আসে। কেউ-বা বন্ধু হারিয়ে ইসলামে প্রবেশ করে। অর্থাৎ কোনো না কোনো কিছু ঘটে যা তাদেরকে থমকে দাঁড়ায়ে চিন্তার দুয়ার খুলে দেয়। আঘাতে জর্জরিত করে প্রশান্ত পথের দিশা দেয়। অন্তরে আঘাত করে ঈমানের পানি বের করে আনার পথ তৈরি করতে হয়। তখন সেই আঘাতের ফলে প্রশস্ত পথ দিয়ে ঈমানের পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে।
এরা দুই ধরনের অন্তর নিয়ে বাস করে (যেমন আবু বকর ও ওমর)।
তাই, দ্বিতীয় ধরনের অন্তরের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاء
﴾কিছু পাথর আছে যাকে ভাঙ্গলে তা থেকে পানি বের হয়। ﴿[আল বাকারা : ৭৪]
কিছু অন্তর এমন যাদেরকে আঘাত দিয়ে ফাঁকা করতে হয়, তবেই সেখান থেকে পানি বের হয়, ঈমান প্রবেশ করে। এসব অন্তর নিজ থেকে উন্মুক্ত হয় না। অন্তরে প্রচন্ড আঘাত করতে হয়, তীব্র ঝাঁকুনি দিতে হয়। এরপরই খুলে যায়। তখন দেখতে পাবেন সেখানেও ঈমানের পানি অবশিষ্ট আছে।
এই বিষয়টা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন জানেন?
মাঝে মাঝে আমরা এমন মানুষদের দেখা পাই যাদেরকে আমরা দাওয়াত দিতে চাই বা অন্তত কিছু নাসিহা দেওয়ার ইচ্ছেপোষণ করি। আপনার পরিবারের দিকেই তাকান। হয়তো আপনার কাজিন রয়েছে যে আপনার থেকে এরকম কিছু শুনতে চায় না। এরকম রয়েছে আপনার ভাই, বোন বা আপনার আংকেল। তারা আপনার কথা শুনতে চায় না অথচ আপনি ভাবেন তাদের অন্তর আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ আপনি হয়তো জানেন না তাদের অন্তরেও পানি থাকতে পারে। সেই পানি নহর হয়ে হয়তো প্রবাহিত হবে। দরকার কেবল নির্দিষ্ট ঘটনার। তখন এই অন্তর উন্মুক্ত হবে। সেখানে ঈমান প্রবেশ করবে। কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে আপনি কেবল কথা বলেই আকাঙ্ক্ষিত ফল প্রত্যাশা করতে পারবেন না। তারা তাদের মতো সময় নেয়।
—কতো সময় নেবে?
আপনার নিজেকেই সেটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
ইসলাম আগমনের কতো বছর পর হামযা (রা) ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন? ওমর (রা) এর কতো সময় লেগেছিল মুসলিম হতে?—জানেন সেটা?
৬ বছর। ইসলামের আগমনের পরেও ৬ বছর পরে তারা ইসলামে প্রবেশ করে। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, এই ৬ বছর ধরে তারা কী করছিল? তারা তো ইসলামের শত্রুও ছিল না। বিষয়টা কৌতূহলী না? ওমর (রা) ইসলামে আসার অল্পকাল পূর্বে মাত্র ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এর পূর্বে এদিকে তেমন মাথাই ঘামাননি তিনি। ফুটন্ত হয়ে ফিস্ফোরিত হওয়ার অল্পকাল আগে ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলেন মাত্র।
তো, এই সাড়ে পাঁচ বছর তিনি কী করেছেন?—ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জীবনকে উপভোগ করে কাটিয়েছেন।
আপনি অমন অবস্থা দেখে হয়তো ভাববেন, ওর ভেতরে কোনো ঈমানের পানি থাকতে পারে না। অন্তত ওমরের মতো মানুষের ভেতরে সেটা সম্ভব না। সে মুসলিম হবে?
—অসম্ভব!
‘সত্যিই? ঐ মানুষটা? সে কি করে বেড়ায় জানো? সে হবে মুসলিম!’
অথচ যখন তাঁর অন্তরে ঝাঁকুনির কাঁপুনি শুরু হলো, সেই অন্তর থেকেও ঈমানের নহর বইতে শুরু করলো। তিনি ঈমান প্রকাশ করলেন। দ্বীনে প্রবেশ করলেন। সাহাবাদের মধ্য থেকে পৃথিবীব্যাপী তিনিই সবচেয়ে বেশি ঈমানের পানি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তৃত্বীয় আরেক ধরনের অন্তর রয়েছে।
وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللّهِ
﴾আর কিছু পাথর আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ে যায়। ﴿[আল বাকারা : ৭৪]
তারা আল্লাহর ভয়ে নত হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তা’আলাএখানে এমন পাথরের কথা বলছেন যে পাথর ভূমিধসের মতো নত হয়ে পড়ে যায়। আপনি এরকম পড়ন্ত পাথরের দৃশ্য মনে করতে পারেন। কিন্তু এই আয়াতে কিন্তু পাথরের ভিতরে পানির উল্লেখ নেই। প্রথম দু’ধরনের হৃদয়ে পানি ছিল। একটিতে বেশি, অন্যটিতে কম। তৃত্বীয়টিতে পানিই ছিল না।
আল্লাহ তা’আলা এখানে ঈমান ছাড়া ইসলামের কথা বলছেন।
আয়াতে ঈমানের উদাহরণ কী হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়েছে? পানি দিয়ে। এখানে পানির কথা উল্লেখ হয়নি কিন্তু আল্লাহর ভয় বিদ্যমান আছে। এটাই আনুগত্য, নত হওয়া। আল্লাহর ভয়ে একজনের নত হয়ে পড়ে যাওয়া যেন কারো সিজদায় নুয়ে পড়ার মতো; আনুগত্য বিদ্যমান থাকা।
পাথর যেমন আল্লাহর ভয়ে নুয়ে পড়ে, এসব মানুষের অন্তরও তেমন। যদিও এরা ইসলামে প্রবেশ করেছে কিন্তু এখনো ঈমানের আসল স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি। তারা ইসলামে আছে ঠিকই কিন্তু ঈমান ঠিক সেরকম মজবুত নয়। তারা মুসলিম হয়েছে। ঈমানের দিকে আসছে। কিন্তু হৃদয়ে সত্যিকার ঈমানের স্বাদ ও প্রশান্তি অনুভব করেনি।
হতে পারে আপনার অন্তর নত হয়েছে। এই ঈমানের মিশনে আপনার জ্ঞানও বশ্যতা স্বীকার করেছে। কিন্তু আপনার হৃদয় এখনো ঈমানের পূর্ণতার স্বাদ পায়নি। যখন আপনার হৃদয় এই স্বাদ পাবে তখন আপনিও চোখের প্রশান্তিকর পানি ঝরাবেন।
আপনার মন আপনাকে কাঁদায় না, আপনার অন্তর (হৃদয়) কাঁদায়। আল্লাহ বলেন:
قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِن قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ
﴾বেদুঈনরা বলে, আমরা ঈমান এনেছি। (‘আমরা ঈমান এনেছি না বলে’) বরং বল, “আমরা (মৌখিকভাবে) আত্মসমর্পণ করেছি কেবল।” এখনও তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। ﴿[সূরা হুজুরাত : ১৪]
❝তোমাদের অন্তরে এখনো ঈমান প্রবেশ করেনি।❞ ‘এখনো তোমাদের পাথরে পানি প্রবেশ করেনি’।
মজার ব্যাপারটি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন। আয়াতটি শুরু হয়েছে ❝তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে পড়েছে, এমন কঠিন যেন তা পাথরের চাইতেও কঠিন।❞ এরপর আল্লাহ তিন ধরনের পাথরের কথা বললেন। এই তিন ধরনের পাথর আসলে উল্লিখিত তিন ধরনের অন্তরের ভিন্ন ভিন্ন হালত তুলে ধরেছে। এই তিন ধরনের অন্তরের আশা আছে। এদের থেকে ঈমানের আশা করা যায়। সে সম্ভাবনা বিদ্যমান আছে।
আল্লাহ তা’আলা কী অনন্য উপমার মাধ্যমে মানবজাতির অন্তরে ঈমানী অবস্থার ভিন্নতাগুলো উপস্থাপন করেছেন!
বই : উপমার শৈল্পিকতায় মুগ্ধময় কুর’আন
মূল : উস্তাদ নোমান আলী খান