পাথরসম হৃদয় (১ম পর্ব)

فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا كَذَلِكَ يُحْيِي اللّهُ الْمَوْتَى وَيُرِيكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

﴾অতঃপর আমি বললাম: গরুর একটি অংশ দিয়ে মৃতকে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন (আর আখিরাতেও করবেন)। আর (এভাবে তিনি) তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখান—যাতে তোমরা চিন্তা কর।﴿ [বাকারা : ৭৩]

উক্ত আয়াতের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। বনী ইজরাঈলের এক সন্তানহীন ধনী ব্যক্তিকে আরেক ব্যক্তি হত্যা করেছিল। কিন্তু কে হত্যা করেছিল সেটা অজ্ঞাত ছিল। গোত্রের মানুষজন এর সুরাহা করতে চাচ্ছিলো। ফলে বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে তারা একটি হলুদ রঙ্গের বাছুর কিনে সেটাকে আল্লাহর নির্দেশমতো জবাই করে। এই জবাইকৃত বাছুরের একাংশ দ্বারা মৃতের শরীরের একাংশে আঘাত করতে বলা হয়। ঠিক সেটা করলে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। এভাবে এই নিদর্শন দেখানো হয় এবং ঘটনার সুরাহা হয়।

এখানে কেবল একটি ঘটনারই সমাধান দেওয়া হয়নি, বরং আয়াতে অন্য আরো বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ দেখালেন তিনি যেকোনো উপায়ে মানুষকে পুনর্জ্জীবিত করতে সক্ষম, ঠিক আখিরাতেও তিনি আমাদের পুনর্জীবিত করবেন—আয়াতে এই বার্তাটিও ছিল অন্যতম। এর মাধ্যমে বোঝায় যে আমাদেরকে তাঁর পথে ফেরত যাওয়া ছাড়া বিকল্প আর কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ দ্বীনের পথে ফিরে যেতে হবে। নইলে আখিরাতে আবার পুনর্জীবিত করা হবে এবং হিসেবের মধ্য দিয়েই যেতে হবে।

দ্বীনের পথে আসতে সবাই একই ধরণের সংগ্রাম ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় না। উপরিক্ত আয়াতে বনী ইজরাঈলের কথা বলা হয়েছে। তাদের অনেক লোক ছিল অকৃতজ্ঞ। ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আবার এমন অনেক লোক ছিল যাদের হৃদয় সত্য পথের দিশা খোঁজে। দেখা যাচ্ছে, সত্যান্বেষী মানুষের সত্য খোঁজার হৃদয়ের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। রয়েছে তাদের পারিপার্শ্বিকতা।

তো, আখিরাতের পুনরুত্থান, পুনর্জীবন, মৃত থেকে জীবিত হওয়া—এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। চিন্তাভাবনা করে বুদ্ধি খাটিয়ে ঈমানে প্রবেশ করা জরুরী। এটাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন:

ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاء وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللّهِ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

﴾(এতো নির্দশন দেখানোর) পরেও তোমাদের অন্তর পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেলো—বরং এর চেয়েও শক্ত-কঠিন। অথচ সেসবের মাঝেও এমন পাথর রয়েছে যা ফেটে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়; কিছু পাথর আছে যাকে আঘাতে ভাঙ্গলে তা থেকে পানি বের হয়; আর কিছু পাথর আছে যা আল্লাহর ভয়ে নত হয়ে ধসে পড়ে। তোমরা কী করো তা আল্লাহর অজানা নয়।﴿ [আল বাকারা : ৭৪]

পূর্বের আয়াতে আল্লাহ বলছেন: কেন তোমরা বুঝ না? কেন তোমরা চিন্তা করো না? কেন তোমরা মন দিয়ে ভাবো না?

মনের সম্পর্ক চিন্তার সাথে। আপনি কোনো কথা বললে দেখবেন আপনার পাশের জন মাঝে মধ্যে খেয়াল করে না। নিকটে থাকলেও বলতে পারে না আপনি এতক্ষণ কী কথা বলেছেন। তখন আপনি বলেন, মন কোথায় ছিল? মন দিয়ে শুনে নাই বলে ব্রেইন নামক মেমোরি সেটা প্রসেস-পক্রিয়ায় ধরে রাখে নাই। আবার বলা হয়, ‘মন দিয়ে পড়াশোনা কর’। মানে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে পড়ালেখা করে মাথায় গেঁথে রাখ। তাহলে মনের সম্পর্ক যেহেতু চিন্তার সাথে ফলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের মনের পরিপক্কতা আসে।

অন্যদিকে অন্তর/হৃদয়ের সম্পর্ক আবেগ-অনুভূতির সাথে। ফলে, এর সম্পর্ক আবেগের উঠা-নামার সাথে, বয়সের পরিপক্কতার সাথে নয়। আবেগের পরিপক্কতা ঘটে না। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা মন দিয়ে ভাবার কাজ করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই অন্তর/হৃদয় দিয়েই।
আয়াতে মানুষের মনের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, তোমরা বুদ্ধি খাটাও না কেন? এই বুদ্ধি না খাটানোর সিদ্ধান্ত কীসের? অন্তর/হৃদয়ের।

এরপরের এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তোমরা যে বুঝতে পারছো না তার কারণ তোমাদের অন্তর/হৃদয়ে মরিচা ধরে গেছে। ফলে,
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ ﴾
(চোখের সামনে অসম্ভব ঘটনা মৃতকে জীবিত হতে দেখার) এতকিছুর পরেও তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।﴿

❝অন্তর কঠিন হয়ে পড়া❞ কখন হয়েছে? একজন মৃত ব্যক্তির জীবিত হওয়া নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করার পর।

অথচ যে ঘটনা অন্তরকে গলাতে পারে সেটা তো মৃত লাশ। কিন্তু এরপরেও তোমাদের অন্তর কঠিনই রয়ে গেলো! এমনকি মৃতব্যক্তির নিথর লাশও কোনো আছর করলো না তোমাদের অন্তরে। এতটাই কঠিন হয়ে গেছে অন্তর।

এই বিষয়টি যদি তোমাদের হেদায়াতের পথে না আনতে পারে, আরি কিছুই তোমাদের জন্য কাজ করবে না।

—❝তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে❞

কখন হলো এমনটি?

—❝এমনকি ঐ (স্পষ্ট ও হৃদয়স্পর্শী চাক্ষুষ ঘটনার) পরও❞ [সূরা বাকারা: ৭৪]

এতকিছুর পরেও কেমনতর হলো অন্তরের অবস্থাটি?

—❝যেন পাথরের মতো কঠিন❞ [সূরা বাকারা : ৭৪]

—❝অথবা তার চেয়েও কঠিন❞ [সূরা বাকারা : ৭৪]

কাঠিন্যের সর্বোচ্চ অনমনীয় অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে তোমাদের অন্তর।

অথচ পৃথিবীতে এমনও অনেক কঠিন পাথর রয়েছে, যাদের ভেতরেও বিভিন্ন অবস্থার তৈরি হয়। সেগুলো কেমন?
وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الأَنْهَار

﴾নিশ্চয় পাথরের মধ্যেও এমন পাথর আছে যা ফেটে নহর প্রবাহিত হয়।﴿

অর্থাৎ সেসব কঠিন পাথরের মধ্য থেকেও তো চিড়েফেটে নদী প্রবাহিত হয়। আর তোমাদের অন্তর কি এর চেয়েও কঠিন? তোমরা কি এতোটাই অবুঝ? অজ্ঞ ও বিবেকহীন?

আসলে, এই আয়াতে যেসব পাথরের বর্ণনা করা হচ্ছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে পাথরের ধরনের বর্ণনা নয়; এগুলো বরং মানুষের হৃদয়ের বিভিন্ন অবস্থার বর্ণনা। এখানে তিন ধরনের পাথরের উল্লেখ করা হবে। সেগুলো আসলে রূপকে বর্ণিত তিন ধরনের মানুষের তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অন্তরের হালত উল্লেখ করা হবে। এই তিন ধরনের অন্তরকে তিন ধরনের পাথরের সাথে তুলনা করা হবে।

বই : উপমার শৈল্পিকতায় মুগ্ধময় কুর’আন
মূল : উস্তাদ নোমান আলী খান