মানুষের মাঝে কিছু মানুষ রয়েছে যারা ভাবুক-চিন্তক। তাদের জ্ঞানের প্রখরতা রয়েছে। কুরআনকে যখন তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তারা তাৎক্ষণিক চিন্তা করে। চিন্তাভাবনা করে তারা খুব দ্রুতই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। তাদের ভেতরে যদি শালীনতা আর দায়িত্ববোধ থাকে তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া খুব দ্রুতই হয়।
আবার কিছু লোক আছে যারা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। যদিও তারা ভালো মানুষ কিন্তু জীবনের অনুভূতি এবং জীবনের আসল উদ্দেশ্য থেকে এরা দূরে সরে গেছে। অপ্রয়োজনীয় অনেক অনুষঙ্গের মাঝে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছে। খেই হারিয়ে ফেলেছে ওসবে মিশে গিয়ে। ফলে, তাদের সাথে কেবল কথা বলে সহজেই ফেরানো যায় না। তাদের অন্তরে কাঁপুনি তোলবার জন্য জীবনে কিছু ঘটে যেতে হয়। জীবনের উপর দিয়ে ঝড়ো কিছু বয়ে যেতে হয়, নাহলে তারা হুশ ফিরে পায় না, স্থির হয়ে চিন্তা করবার ফুসরত পায় না।
তো, আয়াতের প্রথমে যে ধরনের পাথরের কথা বলা হয়েছে সেই পাথর বিস্ফোরিত হয়ে ভেতর থেকে নহর প্রবাহিত হয়।
এই প্রথম ধরনের পাথরের নমুনা কোন ধরনের অন্তরের সাথে তুলনীয়? হযরত আবু বকর (রা) এর অন্তরের সাথে।
তাঁর মাঝে যে সম্ভাব্য ঈমান ছিল, সেটাই নহর। পাথরের ভেতরের পানিই মূলত ঈমান। পানিই এখানে ঈমানের বদলে ব্যবহৃত শব্দ।
রাসূল ﷺ আবু বকর (রা) এর কাছে ইসলামকে উপস্থাপন করলেন। তাঁর ভেতরে যেহেতু পূর্ব থেকেই পানি (=ঈমান, সততা, পরিচ্ছন্নতা, সত্যের তৃষ্ণা) ছিল, ফলে ইসলাম উপস্থাপন করার সাথে সাথেই কী ঘটলো? ঈমান বেরিয়ে আসলো। ঠিক ওসব পাথরের মতো যাতে অল্প পরিশ্রমেই টোকা দেওয়ার সাথে সাথেই নহর প্রবাহিত হতে শুরু করে।
তেমনিভাবে, আবু বকর (রা) এর ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রেও সময়ই লাগলো না; আল্লাহর দ্বীন উপস্থাপন করা হলে তৎক্ষণাৎ তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরকম পবিত্রাবস্থায় সুপ্ত ঈমান বিদ্যমান ছিল তাঁর অন্তরে।
পরবর্তী পাথরের উদাহরণ—একটু কঠিন পাথর। পানি প্রবাহিত হতে সময় নেয়। এতে বেশি আঘাত করে পানি বের করতে হয়। এর উদাহরণ উমর (রা) এর ঈমানের মতো। ভিতরে ঈমান আছে কিন্তু অতোটা দ্রুত চিন্তাশীল অন্তর নয়। চিন্তা আসতে সময় নেয়, আঘাত করতে হয় জোরে। কোনো ধাক্কা খেয়ে চিন্তা করতে শিখে।
ওমর (রা) এই আয়াতের ব্যাখ্যা নয় কিন্তু এই ধরনের অন্তরের একটি উদাহরণ।
আমাদের সমাজেও এমন অন্তরের অনেক লোক বিদ্যমান। অনেক বেখেয়ালি বিষয়ে নিজেদের মিশিয়ে হারিয়ে ফেলেছে জীবনের আসল উদ্দেশ্য। এদের হুশ ফেরাতে বিহ্বলতায় ফেলতে হয়। আকস্মিক কোনো ঘটনায় ডুবাতে হয়। ধাক্কা দিতে হয় বড় মাপের। এছাড়া এদের হুশ হয় না।
ওমর (রা) এর কথা চিন্তা করুন তিনি কীভাবে ইসলামে এসেছিলেন। গল্পটা আপনিও জানেন নিশ্চয়।
সেটা ছিল প্রচন্ড আঘাতের মতো অবিস্মরণীয় ঘটনা। তিনি তাঁর বোনকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেললেন। ঠোট দুটি রক্তে ভিজে কাঁপছে তার বোন, তবুও ইসলাম ত্যাগের নামটি নিচ্ছে না। এই ঘটনার আকস্মিকতা তার চিন্তায় আঘাত করে। এতো আঘাতের পরেও যখন তার বোন ইসলাম ত্যাগে আগ্রহী নয়, তখন একটু হুশ হলো চিন্তার। বোনকে বললেন, পড় দেখি কি পড়ছিলি কুরআন থেকে। তিনি কুরআনের প্রতি মনোযোগ দিলেন।
অথচ একটা সময়ে তিনি কুরআনের প্রতি কোনো মনোযোগ দিতেন না, সেসময়ে যদি এর লিখিত কপি দেওয়া হতো বা শোনার জন্য দেওয়া হতো তবুও তাঁর অন্তরে এই প্রভাব ফেলতো না।
এর অনেক পূর্বেকার আরেকটি ঘটনা রয়েছে উনার। তখনও তাকে নাড়া দিয়েছিল এই কুরআন। কম্পন সৃষ্টি করেছিল তাঁর অন্তরে। কিন্তু প্রচন্ড ধাক্কার মতো তখনো তাঁর অন্তরে কড়াঘাত করেনি।
রাতে ওমর (রা) কা’বার গিলাফের পিছনে লুকিয়ে ছিলেন। তার চিন্তা ছিল নবীর উপর চড়াও হয়ে উনাকে মারবে। নবী ﷺ তখন নামাজ পড়ছিলেন। তিনি রাসূলের সুরেলা তিলাওয়াতের মুগ্ধতায় আনমনে বলে ফেললেন:
—❝এতো দারুণ কবিতা। বেশ সুন্দর তো!❞
এমন সময় রাসুল ﷺ তেলাওয়াত করলেন:
إِنَّهُۥ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ- وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ ۚ قَلِيلًا مَّا تُؤْمِنُونَ
﴾সিঃসন্দেহে এই কিতাব একজন সম্মানিত রাসুলের (আনিত) বাণী। এটা কোনো কবির রচিত কাব্য নয়, যদিও তোমরা খুব কমই বিশ্বাস করো।﴿ [সূরা হাক্কাহ : ৪০-৪১]
হযরত ওমর (রা) বলেন:
—আমি মনে মনে কল্পনা করলাম আর এই ব্যক্তি তো দেখছি আমার মনই পড়ে ফেললো! সে তো সাক্ষাৎ জ্যোতিষী।
এমন সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ তেলাওয়াত করলেন:
وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ
﴾এটা কোনো গণক বা জ্যোতিষীর কথাও নয়; যদিও তোমরা খুব অল্পই বিবেচনা খাটিয়ে চলো﴿ [সূরা হাক্কাহ : ৪২]
—আরে, সে তাহলে এগুলো জানে কীভাবে? জিনিসটা কী?
রাসূল ﷺ তিলাওয়াত করলেন:
تَنزِيلٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ
﴾এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে নাযিলকৃত বাণী। ﴿[সূরা হাক্কাহ : ৪৩]
এরপর ওমর (রা) পালিয়ে গেলেন। কুরআন তাঁর উপর এতোটাই প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি আর নিতে পারছিলেন না।
কুরআন তাকে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। বরং ভয়ে দৌড়ে পালালেন। তিনি বিচলিত হলেন সেই ঘটনায়। ফলে, একেক ঘটনার বিহ্বলতায় তিনি ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেই ফেলেন। তাঁর জন্য এটা ধীর প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু তাঁর ভেতরে ঈমান ছিল, যেমন কিছু কঠিন পাথরের মাঝেও পানি থাকে। ধীরে ধীরে প্রচন্ড আঘাত করতে করতে পানির প্রবহমানতা পাওয়া যায়। তেমনি এই ধরনের অন্তর।
বই : উপমার শৈল্পিকতায় মুগ্ধময় কুর’আন
মূল : উস্তাদ নোমান আলী খান